হৃদরোগের পরে স্ট্রোক হল মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ এবং বিশ্বব্যাপী অক্ষমতার তৃতীয় প্রধান কারণ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্ট্রোক চিকিৎসায় সরাসরি বার্ষিক খরচ ৩৪ বিলিয়ন ডলার বলে জানা গেছে। স্ট্রোকের ফলে মানুষ শারীরিক, মানসিক, আবেগগতভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। স্ট্রোকের ফলাফল ক্ষতের আকার এবং অবস্থানের উপর নির্ভর করে ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়।
স্ট্রোক এমন একটি রোগ যেখানে মস্তিষ্কের একটি রক্তনালীতে রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্ত হয় বা মস্তিষ্কে হঠাৎ রক্তক্ষরণ হয়। একে সেরিব্রো-ভাস্কুলার অ্যাকসিডেন্ট (CVA) বলা হয়।
রক্ত প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেলে বা পরিবর্তিত হলে মস্তিষ্কের একটি অংশ পর্যাপ্ত অক্সিজেন পায় না। ফলে প্রতি মিনিটে মস্তিষ্কের লক্ষ্য লক্ষ্য কোষ মারা যায়, স্থায়ী মস্তিষ্কের ক্ষতি, অক্ষমতা ও মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ায়।
স্ট্রোকের প্রকারভেদ
স্ট্রোককে প্রধান ২ টি ভাগে ভাগ করা যায় - ইস্কিমিক বা রক্তনালী ব্লকজনিত স্ট্রোক এবং হেমোরেজিক বা রক্তক্ষরণজনিত স্ট্রোক।
১) ইস্কেমিক বা রক্তনালী ব্লকজনিত স্ট্রোক কি?
যখন মস্তিষ্কে সরবরাহকারী একটি রক্তনালীতে "রক্ত বা ফ্যাট জমাট" হয়ে যায় ফলে মস্তিষ্কের একটি অংশে রক্ত প্রবাহ ব্যাহত হয়। মস্তিষ্কের কোষ এবং টিস্যু অক্সিজেন ও পুষ্টির অভাবে কয়েক মিনিটের মধ্যে মারা যেতে শুরু করে তখন একে ইস্কেমিক বা রক্তনালী ব্লকজনিত স্ট্রোক বলে।
সাধারনত সমস্ত স্ট্রোকের প্রায় ৮০ থেকে ৯০ ভাগ ইস্কেমিক স্ট্রোক।
ইস্কিমিক বা রক্তনালী ব্লকজনিত স্ট্রোক দুটি উপায়ে ঘটতে পারে:-
v থ্রম্বোসিস : এটি মস্তিষ্কের অভ্যন্তরে রক্তনালীতে রক্ত জমাট বাঁধার কারণে ঘটে।
v এম্বোলিজম : যখন শরীরের বিভিন্ন জায়গায় (যেমন হার্ট বা ফুসফুস) থেকে সৃষ্ট রক্তপিণ্ড প্রবাহের মাধ্যমে মস্তিষ্কের সরু রক্তনালিকায় আটকে গিয়ে রক্ত চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে।
এম্বোলিজম প্রায়ই হৃদরোগ বা হার্ট সার্জারির ফলে হয় এটি দ্রুত এবং কোনো সতর্কতা চিহ্ন ছাড়াই ঘটে।
২)হেমোরেজিক স্ট্রোক বা রক্তক্ষরণজনিত স্ট্রোক কি?
যখন মস্তিষ্কে সরবরাহকারী একটি রক্তনালী ফেটে যায় এবং রক্তপাত ফলে মস্তিষ্কের কোষগুলো অক্সিজেন এবং পুষ্টি পায় না। এছাড়াও, পার্শ্ববর্তী টিস্যুতে চাপ তৈরি করে এবং জ্বালা ও ফোলাভাব দেখা দেয়, যা মস্তিষ্কের আরও ক্ষতির কারণ হতে পারে।
সাধারনত সমস্ত স্ট্রোকের প্রায় ১০ থেকে ১৫ ভাগ হেমোরেজিক স্ট্রোক।
হেমোরেজিক স্ট্রোক দুটি উপায়ে ঘটতে পারে:
v ইন্ট্রাসেরেব্রাল হেমোরেজ: এটি আপনার মস্তিষ্কের অভ্যন্তরে রক্তক্ষরণ ঘটায় ফলে ভিতর থেকে মস্তিষ্কের পার্শ্ববর্তী টিস্যুর উপর চাপ দেয়।
v সাব-অ্যারাকনয়েড হেমোরেজ : আপনার মস্তিষ্কের চারপাশে অ্যারাকনয়েড মেমব্রেন টিস্যুর একটি পাতলা স্তর রয়েছে। সেই ঝিল্লি এবং আপনার মস্তিষ্কের মধ্যবর্তী স্থানটি হল সাব-অ্যারাকনয়েড স্পেস ("সাব" মানে "নীচে")। এই অ্যারাকনয়েড ঝিল্লির মধ্য দিয়ে যাওয়া কোনো রক্তনালী ফেটে গেলে সেগুলি থেকে রক্তক্ষরণ হয়ে সাবরাকনয়েড স্পেস পূরণ করে ফলে মস্তিষ্কের বাইরে থেকে মাথার খুলির ভিতরে চাপ সৃষ্টি হয়।
টিকা: ক্ষণস্থায়ী ইস্কেমিক আক্রমণ (TIA) / মিনি-স্ট্রোকঃ
এটি স্ট্রোকের মতো কিন্তু প্রভাবগুলি অস্থায়ী। এর লক্ষন গুলো ২৪ ঘন্টা পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। এটি একটি সতর্কতামূলক লক্ষণ যার মাধ্যমে বুঝা যায় একজন ব্যক্তির ভবিষ্যতে বড় ধরনের স্ট্রোক হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
যাদের "মিনি-স্ট্রোক" হয়েছে তাদের ৯০ দিনের মধ্যে ১৭ ভাগের স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। প্রথম সপ্তাহে তাদের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।
"মিনি-স্ট্রোক" হলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জরুরি চিকিৎসা সেবা প্রয়োজন।
স্ট্রোক হলে কি করবেন? কিভাবে বুঝবেন স্ট্রোক হয়েছে ?
দ্রুত একটি পরীক্ষা- FAST এর মাধ্যমে স্ট্রোক শনাক্ত করা যায়।
F= Face/মুখ: ব্যক্তিকে হাসতে বলুন। মুখের একপাশ কি বেকে যায়?
A = Arm/হাত: ব্যক্তিটিকে উভয় হাত তুলতে বলুন। একটি হাত কি নিচের দিকে পড়ে যায় ?
S = speech/কথা: ব্যক্তিকে একটি সাধারণ কথা বা বাক্যাংশ বলতে বলুন। তার কথা কি অস্পষ্ট শোনাচ্ছে?
T= time/সময়: আপনি যদি এই লক্ষণগুলির মধ্যে কোনটি লক্ষ্য করেন, তাহলে রুগিকে বিছানায় বা মেঝেতে কাত করে শুইয়ে দিয়ে দ্রুত সময় অ্যাম্বুলেন্স কল করুন এবং হাসপাতালে নিয়ে যান।
রোগীকে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস চলাচল করে এমন স্থানে রাখতে হবে। রোগীর আশেপাশে ভিড় করে কান্নাকাটি করা যাবে না।
গায়ে থাকা কাপড় ঢিলেঢালা করে দিতে হবে যেন রোগী শ্বাস নিতে পারেন।
রোগী জ্ঞান হারালে তার মুখ খুলে দেখতে হবে কিছু আটকে আছে কিনা। ভেজা কাপড় দিয়ে মুখে জমে থাকা লালা, খাবারের অংশ বা বমি পরিষ্কার করে দিতে হবে।
এ সময় রোগীকে পানি, খাবার বা কোন ওষুধ খাওয়ানো যাবে না। কারণ একেক ধরণের স্ট্রোকের ওষুধ একেকরকম।
স্ট্রোকের প্রভাব বা স্ট্রোক পরবর্তী সমস্যা সমূহ কি?
স্ট্রোকের ধরন, তীব্রতা, অবস্থান এবং স্ট্রোকের সংখ্যার উপর ভিত্তি করে এর প্রভাব ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে পরিবর্তিত হয়। মস্তিষ্ক খুবই জটিল, এর প্রতিটি অঞ্চল একটি নির্দিষ্ট ফাংশন নিয়ন্ত্রন করে। স্ট্রোকের কারনে মস্তিষ্কের কোনো অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলে ঐ অংশের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা নষ্ট হয় ফলে শারীরিক অক্ষমতা প্রকাশিত হয়।
মস্তিষ্ক ৩ টি প্রধান অংশে বিভক্ত:
Ø সেরিব্রাম (মস্তিষ্কের উপরে এবং সামনে অবস্থিত)
Ø সেরিবেলাম (সেরিব্রামের নীচে এবং পিছনে অবস্থিত)
Ø ব্রেনস্টেম (মস্তিষ্কের ভিত্তি)
মস্তিষ্কের এই অঞ্চলগুলির মধ্যে কোন স্থানে স্ট্রোক ঘটে তার উপর নির্ভর করে জটিলতা তৈরী হয়।
সেরিব্রামে স্ট্রোকের ফলে কী সমস্যা দেখা যায়?
সেরিব্রাম মস্তিষ্কের সামনের অংশে অবস্থিত। এটি নড়াচড়া, সংবেদন, চিন্তাভাবনা, যুক্তি, স্মৃতি, দৃষ্টি এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে।
এই স্থানে স্ট্রোকের প্রভাবগুলি:
v শরীরের একপাশে দুর্বলতা অথবা পক্ষাঘাত (প্যারালাইসিস) ।
v চিকিৎসকরা একপাশ প্যারালাইসিসকে হেমিপ্লেজিয়া এবং একপাশে দুর্বলতাকে হেমিপারেসিস হিসাবে উল্লেখ করেন।
v কোন বস্তু দেখতে সমস্যা হতে পারে।
v খাবার গিলতে সমস্যা হওয়া।
v স্মরণশক্তি, মনঃসংযোগ ও সমস্যা-সমাধানের ক্ষমতা হারাতে পারে ।
v কথা বলতে, বোঝতে, পড়তে ও লিখতে সমস্যা হতে পারে।
v মলমূত্র ত্যাগের ওপরে নিয়ন্ত্রণ হারাতে পারে।
v আচরণগত পরিবর্তন, যেমন পরিস্থিতি সম্পর্কে উদ্বেগের অভাব, আবেগপ্রবণতা এবং বিষন্নতা
v কখনও কখনও, রোগীরা তাদের ক্ষতিগ্রস্ত দিকের অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে উপেক্ষা করে বা বুঝতে পারেনা। এ অবস্থাকে হেমিনেগলেক্ট বলা হয়।
সেরিবেলামে স্ট্রোকের ফলে কী সমস্যা দেখা যায়?
সেরিবেলাম মস্তিষ্কের পিছনের দিকে অবস্থিত। এটি স্পাইনাল কর্ডের মাধ্যমে শরীর থেকে সংবেদনশীল তথ্য গ্রহণ করে। এটি পেশী ক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ, সূক্ষ্ম নড়াচড়া ও ভারসাম্য নিয়ন্ত্রন করতে সহায়তা করে।
যদিও সেরিবেলাম এলাকায় স্ট্রোক কম দেখা যায়, তবে এর প্রভাব মারাত্মক হতে পারে।
সেরিবেলামে স্ট্রোকের সাধারণ প্রভাবের মধ্যে রয়েছে:
v হাঁটতে অক্ষমতা এবং সমন্বয় ও ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণে সমস্যা হয় (একে অ্যাটাক্সিয়া বলা হয়)
v মাথা ঘোরা বা ভার্টিগো
v মাথাব্যথা
v বমি বমি ভাব এবং বমি
v কোন বস্তু ডাবল দেখা
ব্রেনস্টেমে স্ট্রোকের ফলে কী সমস্যা দেখা যায়?
ব্রেনস্টেমটি মেরুদণ্ডের ঠিক উপরে মস্তিষ্কের গোড়ায় অবস্থিত। হার্টবিট, রক্তচাপ এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো শরীরের অনেক গুরুত্বপূর্ণ "লাইফ-সাপোর্ট" ফাংশন ব্রেনস্টেম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এটি চোখের নড়াচড়া, শ্রবণ, বলা, গিলতে ও চিবানোর সাথে জড়িত প্রধান স্নায়ুগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে।
ব্রেনস্টেমে স্ট্রোকের কিছু সাধারণ প্রভাব:
v শ্বাস এবং হৃদযন্ত্রের কার্যকারিতা হারানো
v শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সমস্যা
v শরীরের ভারসাম্য এবং সমন্বয়ে সমস্যা
v দুর্বলতা বা পক্ষাঘাত (প্যারালাইসিস)
v চিবানো, গিলতে এবং কথা বলায় সমস্যা
v ডাবল ভিশন সহ দৃষ্টিশক্তির সমস্যা,
v দুর্ভাগ্যবশত, ব্রেনস্টেম স্ট্রোকের ফলে মৃত্যু সম্ভব।
রোগ নির্ণয়ঃ
আপনি হাসপাতালে পৌঁছানোর পরে জরুরী চিকিৎসক দল আপনার কী ধরণের স্ট্রোক হচ্ছে তা নির্ধারণ করার চেষ্টা করেন। এর মানে আপনি পৌঁছানোর পরপরই একটি সিটি স্ক্যান বা অন্য ইমেজিং পরীক্ষা করতে পারবেন। আপনার উপসর্গের অন্যান্য সম্ভাব্য কারণ যেমন মস্তিষ্কের টিউমার বা ওষুধের প্রতিক্রিয়া হয়েছে কিনা নিনর্নয় করবেন।
এজন্য কিছু পরীক্ষা অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে:
খ) রক্ত পরীক্ষা : কত দ্রুত রক্ত জমাট বেঁধেছে, রক্তে শর্করার পরিমাণ খুব বেশি বা কম এবং আপনার সংক্রমণ হয়েছে কিনা এ জন্য আপনার রক্ত পরীক্ষা করা যেতে পারে।
গ) কম্পিউটারাইজড টমোগ্রাফি (CT scan ) স্ক্যান : সিটি স্ক্যান আপনার মস্তিষ্কের একটি বিশদ চিত্র তৈরি করে। সিটি স্ক্যানের মাধ্যমে মস্তিষ্কে রক্তপাত, ইস্কেমিক স্ট্রোক, টিউমার বা অন্যান্য অবস্থা দেখাতে পারে। ঘাড় এবং মস্তিষ্কের রক্তনালীগুলিকে আরও বিশদভাবে দেখতে ডাক্তাররা আপনার রক্তপ্রবাহে একটি রঞ্জক ইনজেকশন দিতে পারেন। এটি CT Angiography (কম্পিউটারাইজড টমোগ্রাফি অ্যাঞ্জিওগ্রাফি ) নামে পরিচিত।
ঘ) ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স ইমেজিং (MRI) : এমআরআই শক্তিশালী রেডিও তরঙ্গ এবং চৌম্বক ক্ষেত্র ব্যবহার করে মস্তিষ্কের বিশদ দৃশ্য তৈরি করে। একটি এমআরআই মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ ফলে ক্ষতিগ্রস্ত টিস্যু সনাক্ত করতে পারে। ডাক্তার ধমনী ও শিরার রক্ত প্রবাহ হাইলাইট করার জন্য রক্তনালীতে রঞ্জক ইনজেকশন করতে পারেন। এটি MRA (ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স এনজিওগ্রাফি বা ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স ভেনোগ্রাফি) নামে পরিচিত।
ঙ) ক্যারোটিড আল্ট্রাসাউন্ড: এই পরীক্ষায়, শব্দ তরঙ্গগুলি ঘাড়ের ক্যারোটিড ধমনীর ভিতরের বিশদ চিত্র তৈরি করে। এছাড়া ক্যারোটিড ধমনীতে ফ্যাট জমা এবং রক্ত প্রবাহ দেখায়।
চ) সেরিব্রাল এনজিওগ্রাম: এই পরীক্ষার মাধ্যমে মস্তিষ্ক এবং ঘাড়ের ধমনীগুলির একটি বিশদ দৃশ্য পর্যবেক্ষন করা যায়।
ছ) ইকোকার্ডিওগ্রাম: ইকোকার্ডিওগ্রাম শব্দ তরঙ্গ ব্যবহার করে হার্টের বিশদ চিত্র তৈরি করে । এর মাধ্যমে হৃৎপিণ্ডে রক্ত জমাট বাঁধার উৎস খুঁজে পাওয়া যায়।
To Click স্ট্রোকের মেডিকেল চিকিৎসা
0 মন্তব্যসমূহ